জান্নাতুন নাঈম জ্যোতি~বিরল:
প্রত্যেকের
জীবনেই এমন কোনো স্মৃতিবিজড়িত
স্থান আছে,যে স্থানে
জড়িয়ে থাকে তার রঙিন
শৈশব এবং দুরন্তপনার অতীত
দিনগুলোর স্মৃতি। সেই স্থানের প্রতিটি কোণে লুকিয়ে থাকে
অমূল্য পুরোনো
কিছু আবেগ।
প্রত্যেকের
মতো আমাকেও যদি জিজ্ঞেস করা
হয়,তোমার সবথেকে স্মৃতিবিজড়িত এবং প্রিয় স্থান
কোনটি? আমি
নির্দ্বিধায় আমার শৈশব কাটিয়ে
ওঠা স্থানটিরই নাম বলব। অতীতের স্মৃতির
তাড়নায় আজ সেই স্থানটিরই
সম্পর্কে আমার খুব বলতে
ইচ্ছে করছে...!
শহরের
ধার ঘেঁষে কলকল কলতানে বয়ে
চলেছে পূণর্ভবা নদী। শহরটির নাম দিনাজপুর।শোনা যায়,
দিনারা ছিলেন দিনাজপুর রাজ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা
এবং তার নামেই পরিচিত
হয় দিনাজপুর। এটি
বৃহত্তর জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি জেলা।
নিম্নে
সংক্ষিপ্ত আকারে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বিরল উপজেলার কিছু
বর্ণনা তুলে ধরার চেষ্টা
করলামঃ
আয়তন, অবস্থান এবং
সীমানা:
বিরল
উপজেলার আয়তন ৩৫২.১৬
বর্গ কিলোমিটার। এটি ২৫°৩১`-২৫°৪৬` উত্তর অক্ষাংশ
এবং ৮৮°২৬` থেকে
৮৮°৩৮` দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত।
সীমানা:
এর
উত্তরে বোচাগঞ্জ ও কাহারোল উপজেলা,দক্ষিণে দিনাজপুর সদর উপজেলা ও
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, পূর্বে দিনাজপুর সদর উপজেলা ও
পূণর্ভবা নদী এবং পশ্চিমে
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও বোচাগঞ্জ উপজেলা।
জনসংখ্যা:
এখানে
প্রায় ২,৫৭,৯২৫
জন (২০১১ সালের আদমশুমারী
অনুযায়ী) লোকের বাস। এখানে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা
শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে।
এছাড়াও
সাঁওতাল, ওরাও, মুন্ডা, মালো,মা হালী প্রভৃতি
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে।
নদ ও নদী:
পূণর্ভবা
নদী ছাড়াও এখানে টাংগন নদী,নাল বিল
এবং কড়াই বিল বিশেষ
উল্লেখযোগ্য।
*অন্তর্গত
ইউনিয়নঃ ১২ টি।
স্থলবন্দর:
দিনাজপুর
শহর হতে ১৫ কিলোমিটার
পশ্চিমে অবস্থিত বিরল সীমান্ত স্থল
বন্দর।এই স্থললবন্দরের বাংলাদেশ অংশে রয়েছে দিনাজপুর
জেলার বিরল উপজেলা এবং
ভারত অংশে রয়েছে উত্তর
দিনাজপুর জেলার রাধিকাপুর। বিরল স্থলবন্দরটি মূলত রেলকেন্দ্রীক।
নান্দনিক দর্শনীয় স্থান
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বিরল উপজেলায় বেশ কিছু নান্দনিক স্থান রয়েছে যেসব দেখে ভ্রমণপ্রিয়
এবং প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের প্রাণ শীতল হয়ে যায়। এদের
মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নান্দনিক দর্শনীয় স্থানের কথা উল্লেখ করছি।
শালবন:
এই
শালবনটি অবস্থিত ধর্মপুর ইউনিয়নে।বনের বিভিন্ন স্হানে রয়েছে অনেক পুরোনো শালগাছ।
বনবিড়াল, খেঁকশিয়াল,
বেজীসহ পাখি রয়েছে ২০-২৫ প্রজাতির। বন এলাকার
ভেতর দিয়ে যোগাযোগের জন্য
রয়েছে বেশ কয়েকটি পাকা
রাস্তা। এসব স্থান দিয়ে স্থানীয়সহ বহিরাগত
লোকজন যাতায়াত করে থাকে। রাস্তাগুলো পরিপাটি
এবং আঁকাবাঁকা। এ আঁকাবাঁকা পথ
ধরে যতোই বনের ভেতরে
যাওয়া যায় চোখে পড়ে
সারি সারি শালগাছ।
এই
আঁকাবাঁকে পথে যাওয়ার সময়
আনমনে গেয়ে উঠতে ইচ্ছে
করবে,
"এই
পথ যদি না শেষ
হয়...
তবে
কেমন হতো তুমি বলোতো!......"
এই
বনে শাল গাছের মাঝারি
আকারের পাতাগুলো গাঢ় সবুজের সমারোহে
অন্য রকম এক পরিবেশের
সৃষ্টি করে।মাঝে মাঝে পাতার ফাঁক
দিয়ে অনুরাগের সুরে হঠাৎ করে
ঘুঘু ডেকে ওঠে।এইরকম
রোমাঞ্চকর অনুভূতি এবং প্রাণজুড়ানো প্রকৃতির
প্রত্যক্ষদর্শী হতে চাইলে আপনাকে
অবশ্যই এই শালবনে আসতে
হবে।
কড়াইবিল:
বর্ষার
ভরপুর জল,শরতের মেঘের
ছায়াপড়া নীল পানি,চৈত্রের
দুপুরে তপ্ত আধাজল আর
হেমন্তের বিকেলে নীরব নিথর পানির
এই কড়াইবিলকে বিভিন্ন ঋতুতে দেখতে পাওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন
রুপে। তবে
শীতে এখানে অতিথি পাখির নানা রং এর
পাখায় আকাঁ নকশাকে কবির
কল্পনা এবং শিল্পীর আঁকা
ছবি দুটোই বলা যেতে পারে।
পাড়সহ কড়াই বিলের আয়তন
৪৬ একর । শীতে
কড়াই বিল অতিথি পাখিতে
ভরে যায়। সুদূর সাইবেরিয়া
থেকে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে
পাখিরা আসে। পাখির জলকেলি
দেখতে ছুটে যায় উৎসাহী
মানুষ। শীতের শেষে পাখিরা ফিরে
যায় নিজ আলয়ে। বিলের
পাড় দিয়ে যেতে যেতে
চোখে পড়বে টমেটো, কুমড়া,
ধনে পাতা ও নানা
ধরনের ওষুধি গাছ ও ফুলের
গাছ। দিনাজপুর থেকে যাওয়ার পথে
পড়বে দিগন্তজোড়া ধানক্ষেত। হেমন্তে বেড়াতে গেলে রাস্তা থেকেই
পাবেন ধানের মৌ মৌ ঘ্রাণ।
মন হারিয়ে যাবে অন্যরকম এক
ভালোলাগার জগতে। তবে বিরল বিল
বলা হলেও এটা আসলে
বড়ো একটা দিঘী।
১৯৭৪
সালে ১৬ এপ্রিল সরকার
এই বিলটি মুক্তিযোদ্ধা সমবায় সমিতির নামে রেজিস্ট্রি করে
দেয়। বর্তমানে সেখানে শিশু, আকাশমণি, দেশি কড়ই, আমলকি,
মেহগনি, আম, কাঁঠাল, লিচু,
জাম, বেলসহ নানা জাতের ১৫০০
গাছ রয়েছে। বিরল থানায় কড়াই
বিল পেরিয়ে আর একটু সামনে
গেলে শুরু হবে যে
গ্রাম সেখান থেকে সামনে যতদূর
যাবেন শুধু লিচুগাছ আর
লিচুবাগান। গ্রামের নাম মাধববাটি। সেখানে
গিয়ে বলবেন এতো মাধববাটি নয়
যেন লিচুর রাজ্য। লিচুর দিনে দিনাজপুর ভ্রমনের
মজাই হবে অন্যরকম।
দীপশিখা মেটি
স্কুল
দিনাজপুর
জেলার বিরল উপজেলার মঙ্গলপুর
ইউনিয়নে রুদ্রাপুর গ্রামে মাটির তৈরি দোতালা স্কুলের
নাম “দীপশিখা মেটি স্কুল” । এর খ্যাতি মাটি
ও বাঁশ দিয়ে তৈরি
ভিন্নধর্মী নির্মাণশৈলীর জন্য। এই কারণেই ২০০৭ সালে এই
স্থাপনা অর্জন করে আগাখান আর্কিটেকচার
অ্যাওয়ার্ড। রুদ্রাপুর বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম
হলেও স্কুলটির কল্যাণে এখন দেশ-বিদেশের
মানুষের কাছে বিখ্যাত একটি
গ্রাম।
গোবরার বিল:
পদ্মফুল
দেখতে কার না ভালোলাগে!বাতাসে দোল খাওয়া পদ্মফুল
যেনো প্রকৃতির এক অন্যতম উপহার। হ্যাঁ,পদ্মফুলের সাথে ভাব জমানো
এই বিলটির নাম গোবরার বিল,
যেখানে সাদা বকের আনাগোনায়
এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। দক্ষিণে কালিয়াগঞ্জ থানা অতিক্রম করে
বিজিবি ক্যাম্পের ঠিক পরেই সন্ধান
পাওয়া যায় গোবারার বিল
নামক বিলটির।
এই
বিলের সহস্রখানেক পদ্মফুলের উচ্ছ্বাস ঠিক যেনো অন্যরকম
এক ভালোলাগায় মনটাকে আপ্লুত করে দেয়।
এছাড়াও
ছোটদের বিনোদনের জন্য রয়েছে দৃষ্টিনন্দিত
জীবন পার্ক।
বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ:
বিরল
উপজেলায় জন্ম নিয়েছেন কিছু
বিখ্যাত ব্যক্তি। যেমনঃ সাবেক শিক্ষামন্ত্রী শাহ্ মোহাম্মদ ইউসুফ,
সেনাপ্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান, সমাজসেবক ও প্রখ্যাত নাট্যকার
এবং শাহ্ মোহাম্মদ শাহ্জাহান,
সাবেক মন্ত্রী সতীশ চন্দ্র রায়
এবং বর্তমান নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
অন্যান্য:
বিরল উপজেলার অধিবাসীরা শিক্ষার প্রতি খুব সচেতন।এখানে পর্যাপ্ত
পরিমাণে সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এবং কিন্ডারগার্টেন স্কুল
রয়েছে। শিক্ষার্থীরা পায়ে হেঁটে কিংবা
সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে যখন পাখির মতো
ঝাঁক বেঁধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যায়, সেটা দেখে
অজান্তেই মনটা আনন্দে ভরে
ওঠে।
এখানে
চিকিৎসা ব্যবস্হাও চমৎকার।জণগণের সেবায় নিয়োজিত এখানে একটি ১০০ শয্যা
বিশিষ্ট সরকারি হাসপাতাল ও রয়েছে।
এখানে
রয়েছে দিগন্তজোড়া খেলার মাঠ,যেখানে ছেলে-মেয়েরা নানারকম খেলায় মেতে ওঠে।মাঠের পাশে
ঝকঝক শব্দ করে হুঁইসেল
বাজিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে যায় রেলগাড়ি।
রয়েছে স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার। জাতীয় দিবসগুলো
এলে শিক্ষার্থীদের পিটি-প্যারেড এবং
ডিসপ্লে প্রদর্শনের মাধ্যমে পালিত হয় বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান।
ফুলে ফুলে ভরে ওঠে
শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধের প্রাঙ্গন।
মসজিদগুলোতে
মোয়াজ্জিনের কন্ঠে নামাজের ডাক শুনে দল
বেঁধে নামাজে যায় মুসল্লিরা। ঈদের দিনে
তারা একে অপরের সাথে
কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কোলাকুলি
করে আনন্দ ভাগাভাগি করে।
হিন্দুরা
শঙ্খ বাজিয়ে উলু দিয়ে সন্ধ্যা
আরতি পালন করে। বিভিন্ন উৎসব,পূজা-পার্বণে তারা
একে অপরের সাথে মেতে ওঠে।
এছাড়াও
বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও
তাদের ধর্মীয় উৎসব নির্বিঘ্নে পালন
করে।
এই
হলো আমার স্বপ্নের স্হান।
স্বপ্নের স্হানটি
যেনো স্বপ্নের মতোই সুন্দর,যেখানে
আমি আমার হারিয়ে যাওয়া
শৈশবকে খুঁজে পাই,বুকে ধারণ
করে রাখতে পারি আমার ফেলে
আসা সুখ দুঃখগুলোকে। বিরল নামটির
মতোই জায়গাটি "বিরল " হয়ে থাকুক অস্তিত্বে,স্মৃতিতে এবং মননে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not enter any spam link in the comment box